মৃত্যুদিনে ফিরে দেখা ‘মাস্টারদা’র জীবন

নিউজটাইম ওয়েবডেস্ক :

আজ যে ভারতে বাস করছি আমরা, সেই দেশকে স্বাধীন করার সংগ্রাম লেখা রয়েছে রক্তে। কত আত্মত্যাগ, কত বলিদান স্বাধীন করেছে ভারত মাকে। সেই দেশ মাতৃকার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সূর্য সেন। ইতিহাস যাঁকে  চেনে ‘মাস্টারদা’ হিসেবে। আজ সেই মাস্টারদার মৃত্যুদিন। আজই তিনি দেশের জন্য ফাসির মঞ্চে উঠেছিলেন। সেই মাস্টারদার জীবনেই ফিরে দেখা হোক আজকের দিনে।

সূর্য সেনের জন্ম : চট্টগ্রাম জেলার নোয়াপাড়ায় জন্ম গ্রহন করেছিলেন সূর্য সেন। বাবা ছিলেন রাজমণি সেন, মাতা শশীবালা দেবী। তবে তাঁর জন্মদিবস নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলেন তাঁর জন্ম হয়েছে ১৮৯৩ সালে ২৫ অক্টোবর। আবার কেউ বলেন তাঁর জন্ম ১৮৯৪ সালে ২২ মার্চ। তবে ইতিহাসবিদরা দ্বিতীয় তারিখটিকেই সমর্থন করে থাকেন। ছয় ভাই বোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান ছিলেন তিনি।

সূর্য সেনের শিক্ষাজীবন : দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় তাঁকে। জাতীয় স্কুল থেকে ১৯১২ সালে এন্ট্রান্স পাশ করেন তিনি। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু খুব বেশিদিন পড়া হয়নি সেখানে। ১৯১৪ সালে বার্ষিক পরীক্ষার দিন, বাড়ি থেকে বেরোতে দেরী হয়ে গিয়েছিল সূর্য সেনের। কোনওভাবে পরীক্ষার হলে ঢুকে, খাতা নিয়ে পরীক্ষা দিতে বসেন তিনি। লেখা শুরু করেছেন, এমন সময় পরিক্ষক এসে তাঁকে বলেন, তিনি অসাধু পথ অবলম্বন করছেন। তিনি নাকি বই দেখে টুকে পরীক্ষা দিচ্ছেন। প্রতিবাদ করতে পারেননি সূর্য সেন। বেঞ্চে সত্যিই একটি বই রাখা ছিল। তাড়াহুড়ো করে পরীক্ষা দিতে বসেই এই ভুল হয়ে যায় সূর্যর। পরীক্ষাকেন্দ্রে অসাধু উপায় অবলম্বনের অভিযোগে তাঁকে বিতাড়িত করা হয় কলেজ থেকে।

সেই সময় অনেকেই তাঁকে বলেছিলেন, কিছু টাকা দিয়ে একটি কলেজ পাশের সার্টিফিকেট যোগাড় করতে। কিন্তু কোনওরকম অসাধু উপায় অবলম্বন করতে রাজি ছিলেন না তিনি। কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এলেন মুর্শিদাবাদ। সেখানে এসে বহরমপুর কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করে, বিস্তারিত জানালেন তাঁকে। সূর্যের সততা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন অধ্যক্ষ। সূর্য সেনকে ভর্তি নিলেন কলেজে। ১৯১৭ সালে বহরমপুর কলেজ থেকে বিএ পাশ করলেন সূর্য সেন।

সূর্য সেনের কর্মজীবন ও বিপ্লবী জীবন : সূর্য সেনের কর্মজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিপ্লবীজীবন। নোয়াপাড়া জাতীয় বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হেমেন্দ্রলাল মুখোটি, সূর্য সেনকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। এরপর বহরমপুর কলেজে পড়ার সময়ই তিনি গুপ্ত বিপ্লবী আন্দোলনের কথা শোনেন। বিপ্লবী নেতা সতীশ চক্রবর্তীর থেকে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেয়ার অনুপ্রেরণা পান। এরপর সূর্য সেন ঠিক করেন, দেশকে স্বাধীন করতে তিনিও সংগঠন তৈরি করবেন। এরপর চট্টগ্রামে গিরে গিয়ে উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তবে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সংগঠন তৈরি করা।

১৯১৭ সালে অনুরূপ সেন, নগেন সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, চারুবিকাশ দত্তকে নিয়ে সূর্য সেন তৈরি করলেন একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থা। একে একে আরও বিপ্লবী যোগ দিতে শুরু করলেন সেই সংগঠনে। সূর্য সেন হয়ে উঠলেন সকলের ‘মাস্টারদা’। অচিরেই বুঝতে পেয়েছিলেন দেশকে স্বাধীন করতে প্রয়োজন অস্ত্র। আর সেই অস্ত্র কিনতে প্রয়োজন অর্থের। তাঁর নেতৃত্বে অসম-বাংলা রেলওয়ে অফিস থেকে তরুণ বিপ্লবীরা ১৭ হাজার টাকা লুঠ করল। ১৯২৬ সালে সূর্য সেন চট্টগ্রাম কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সেই বছরই সূর্য সেনকে গ্রেফতার করা হল, রেলওয়ে অফিস থেকে অর্থ লুঠের অভিযোগে।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন : দু বছর পর ১৯২৮ সালে মুক্তি পেয়ে মাস্টারদা ব্যায়াম সমিতি তৈরি করলেন। শরীর চর্চার পাশাপাশি বিপ্লব চর্চাও হতে লাগল সেখানে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুঠ করার পরিকল্পনা নিয়ে, ধীরে ধীরে গড়ে উঠল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা। চট্টগ্রাম লুন্ঠনের চূড়ান্ত দিন ঠিক হল, ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। মাস্টারদার নেতৃত্বে তরুন বিপ্লবীরা আক্রমন করল ব্রিটিশ অস্ত্রাগার। চট্টগ্রামের সঙ্গে যেন অন্যান্য জেলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, তাই উপড়ে নেওয়া হল রেল লাইন। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল টেলিফোন, টেলিগ্রাম ব্যবস্থা। মাস্টারদার ভয়ে মাঝপথে আশ্রয় নিয়েছিল ব্রিটিশ কর্মচারীরা। প্রায় ৪৮ ঘন্টার জন্য আতঙ্কে ছিলেন ব্রিটিশরা। আর এই ৪৮ ঘন্টা ব্রিটিশ শাসন মুক্ত ছিল চট্টগ্রাম।

মাস্টারদার মৃত্যু : যে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন মাস্টারদা, তার জন্য ব্রিটিশরা তাঁকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়। মাস্টারদাকে আড়াল করার জন্য তরুন বিপ্লবীরা টানা তিন বছর গেরিলার যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। মাস্টারদার কাছের লোকই তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। চট্টগ্রামের গইরালাতে গা ঢাকা দিয়েছিলেন তিনি। মাস্টারদার এক জ্ঞাতি ভাই সেই খবর পৌঁছে দেয় ব্রিটিশদের কানে। গ্রেফতার হল মাস্টারদা। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ফাসি দেওয়া হয় মাস্টারদাকে।

Inform others ?
Share On Youtube
Show Buttons
Share On Youtube
Hide Buttons
Wordpress Social Share Plugin powered by Ultimatelysocial
Facebook
YouTube